হুকার, হজসন, হোলিঃ সুপ্রিয় ঘটক

প্রবন্ধ


হুকার, হজসন এবং হোলি

সুপ্রিয় ঘটক

 স্যার জোসেফ ডালটন হুকার

 

 সে বার  দোল উৎসব ছিল ৮ই এবং ৯ই মার্চ। সে বার বলতে ঠিক ১৭৩ বছর আগের কথা বলছি । সাল  ১৮৪৯। সেই বছর  মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহেই জলপাইগুড়ি রাজবাড়িতে পা পড়ল দুই বিখ্যাত ব্যক্তির। তাঁরা হলেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী জোসেফ ডালটন হুকার আর হিমালয় বিশেষজ্ঞ ব্রায়ান হটন হজসন সাহেব। এনারা কারা, আর জলপাইগুড়িতেই বা কেন আসলেন?                                                                                                                                            

হুকারের লেখা ‘জেনারা প্লান্টারাম’ আর  ‘দি ফ্লোরা অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের কাছে অতি পরিচিত নাম। এ ছাড়াও ‘রডডেনড্রনস অব সিকিম-হিমালয়’ এবং যে বই থেকে আমার এই লেখা সেই ‘দি হিমালয়ান জার্নাল’–এ সব বইয়ের আকর্ষণ আজও অপ্রতিরোধ্য। ব্যক্তিজীবনে হুকার ছিলেন ডারউইনের বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী। হুকার  তাঁর ‘হিমালয়ান জার্নাল’ উৎসর্গ করেছিলেন  ডারউইনকে । মনে রাখতে হবে তখনও ডারউইন জগৎবিখ্যাত হননি – তখনও লেখেননি ‘অরিজিন অব স্পিসিস’ । হুকার ভারতবর্ষে আসেন ১৮৪৮ সালের ১২ই জানুয়ারি , আর ১৮৫১ সালের মার্চ মাসে নিজের দেশ ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এই সাড়ে তিনবছরে তাঁর এবং তাঁর দলের সংগ্রহে জমা হয়েছিল ৬০০০-৭০০০ ভারতীয় উদ্ভিদপ্রজাতির দেড়-লক্ষাধিক নমুনা। অবশ্য ভারতে আসার আগেই তিনি যথেষ্ট নাম কুড়িয়েছিলেন – কুমেরু সমেত পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগৃহীত গাছগাছড়ার উপর বই লিখে।

 

 

 ব্রায়ান হটন হজসন

 

ভারতবর্ষে এসে হুকার তাঁর অনেক দেশওয়ালি সাহেবদের সাহায্যই পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর ‘হিমালয়ান জার্নাল’–এর ভুমিকায় যার কথা সব চেয়ে বেশি লিখেছেন তিনি হলেন ব্রায়ান হজসন। আর লিখবেন নাই বা কেন, হজসনের মত হিমালয় পাহাড় আর কে বুঝবেন! ১৮২০ থেকে ১৮৪৩ অবধি হজসন নেপাল রাজদরবারে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেছেন  শেষের দিকে ব্রিটিশ রেসিডেনট হিসেবে। এই ২৩ বছরে নিজের অনুসন্ধিৎসাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন নানা দিকে  হিমালয়ের প্রকৃতি ও জীব-জন্তু, নৃতত্ত্ব ও জাতিতত্ব, বৌদ্ধধর্মের চর্চা আর তিব্বত চর্চা–সবেতেই তিনিই ছিলেন পথপ্রদর্শক। কিন্তু তিনি জড়িয়ে পড়লেন নেপালের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে, বিরাগভজন হলেন ওপরওয়ালার। তখনকার গভর্নর-জেনারেল লর্ড এলেনবরোর চাপে ১৮৪৪ সালে পদত্যগে বাধ্য হলেন। অভিমানে ফিরে গেলেন দেশে। কিন্তু ভালবেসেছেন হিমালয়কে  ইংল্যান্ডে তাই মন টিকলো না , আবার ১৯৪৫ এ ফিরে এলেন ভারতে। তবে নেপালে যাওয়ার অনুমতি মিললো না। কিন্তু তিনি হিমালয়ের কোলেই থাকবেন, তাই ঘাঁটি গাড়লেন দার্জিলিঙে। এই দার্জিলিঙে থাকাকালীনই হুকারের সঙ্গে হজসনের মোলাকাত হয়। ১৮৫৮ সালে হজসন পাকাপাকি ভাবে দেশে ফিরে যান।    

১৮৪৮ সালের এপ্রিল মাসে এই দুই ব্যক্তির প্রথম দেখা হয় হজসনের দার্জিলিঙের বাড়ির বাগানে। হুকারের লিখেছেন তাঁর প্রথম দর্শনের কথা –‘তিনি একজন চৈনিক চেহারার লোকের সঙ্গে তিব্বতীয় ভাষায় মধ্য এশিয়ার ভূপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন।‘ সতের বছরের পার্থক্য সত্ত্বেও তাদের মধ্যে অচিরেই গভীর বন্ধুত্ত্ব গড়ে ওঠে। ‘হিমালয়ান জার্নাল’-এর ভুমিকার অনেকটাই হুকার ব্যায় করেছেন হজসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে।  

 

 হজসনের দার্জিলিঙের বাংলো থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্য - যেমনটা দেখেছিলে হুকার  

 

এবার আসি  হুকার এবং হজসন জলপাইগুড়িতে কেন আসলেন সেই প্রসঙ্গে। তাঁরা যখন জলপাইগুড়িতে আসলেন তখন হুকারের ভারতবর্ষে এক বছর কেটে গেছে, হজসনের সঙ্গে বন্ধুত্বও প্রায় এক বছর হতে চললো। এরই মধ্যে হুকার সমতলে কিছু জায়গা আর সিকিমে ঘুরে এসেছেন- সংগ্রহ করেছেন গাছ-গাছালি। সিকিম থেকে ফেরার পথে হুকার এলেন দারজিলিং, তাঁর সংগৃহীত নমুনা গাছগুলি সংরক্ষনের ব্যবস্থা করলেন । কিন্তু হজসন তখন দার্জিলিঙে ছিলেন না। তাই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে হুকার চললেন তেঁতুলিয়া। তেঁতুলিয়া থেকে দুই বন্ধু টাট্টু ঘোড়ায় চেপে লোক-লস্কর নিয়ে রওনা  হলেন জলপাইগুড়ির উদ্দেশে। জলপাইগুড়ির দেওয়ানের কাছ থেকে হাতি নিয়ে তারা শিলিগুড়ির দিকে যাবেন, এই ছিল তাদের পরিকল্পনা। তাহলে হাতি জোগাড় করার কথা ভেবেই জলপাইগুড়িতে দুই ব্যক্তির আবির্ভাব। কিন্তু সামনেই ছিল দোল উৎসব, উৎসব শেষ না হলে হাতি মিলবে না বলে দেওয়ান সাফ জানিয়ে দিলেন। অতএব কি আর করা, দুই বন্ধুকে কিছুদিন জলপাইগুড়ি থাকতেই হল।

সেই ১৭৩ বছর আগে হুকার সাহেব জলপাইগুড়ি কেমন দেখলেন? “যাত্রার দ্বিতীয় দিনে আমরা জলপাইগুড়ি নামে এক গ্রামে পৌঁছলাম। বেশ স্বচ্ছল ছড়ানো ছেটানো, তিস্তা নদীর ধারে আর দক্ষিণের জঙ্গল থেকে বেশ খানিকটা দুরের এই বড় গ্রাম। “আর লোকজন? “এরা প্রধানত কৃষিজীবী। খুব সরল, সাধাসিধে, ভীতু প্রকৃতির, অত্যাচারিতও। আমাদের দেখলেই এরা পালিয়ে যায়। এদের কাছ থেকে সামান্য রাস্তার হদিশ জানতেও প্রানান্তকর অবস্থা হয়। উদ্ভিদবিদের চোখ এড়ায়নি যে – “বট, পিপুল, কাঁঠাল, আম, তেঁতুল গাছে গ্রামটি ঘেরা। গ্রামের চারিদিকে দিগন্তছোঁয়া ধানক্ষেত। কলা, সুপুরি, পান ছাড়া আর কোনো কৃষিপণ্য চোখে পড়েনি। নিজেদের খাওয়ার জন্য তৈলবীজ, রাঙাআলু, মিষ্টি গোল আলুর চাষ করে। বাড়ির চারপাশে, সম্পত্তির সীমানায় বাঁশ লাগানো হয়। … রাস্তার ধারে উজ্জ্বল রঙের দাঁতরাঙা, ঘেঁটু আর তিন জাতের ফার্ন – বড়ো বড়ো গাছের নীচে এরা সর্বদাই ঝোপ তৈরি করে থাকে । ঘেঁটু ফুলের মিষ্টি আর তীব্র সুগন্ধ সবসময় বাতাসে ভেসে থাকে। “ঘেঁটু ফুল যে শিবের পুজায় দেওয়া হয় সে কথাও জানাতে ভোলেন নি হুকার। সেই সময় স্থানীয় মানুষ যেমন বাড়িতে থাকতো তার তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করেছেন – “বাড়িগুলো দেখতে খুব সুন্দর। সাদা চুনকাম করা মাটির বারান্দা বাইরে থেকে দেখা যায়। ছাদের নির্মাণ-কৌশল দেখার মত। নিপুন ভাবে বোনা কালো রঙের চাল ঢালু হয়ে মাটি অবধি নেমে এসেছে। দূর থেকে দৈত্যাকার হাতির পিঠের মতো দেখায়। “জলপাইগুড়ির রাজবাড়ি, তার প্রবেশ-তোরণ আজও টিকে আছে। ১৭৩ বছর আগে হুকার এই রাজবাড়ি কেমন দেখলেন সেটা তার বর্ণনায় দেখা যাক – “এক সন্ধায়, রাজপ্রাসাদে বালক রাজার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। দূর থেকে প্রাসাদটি ভালো দেখাচ্ছিল। আম, সুপুরি, নারকেল গাছের উপবনের ভেতরে প্রাসাদের সাদা দেওয়াল জ্বলজ্বল করছিলো। একটা ছোটো গ্রাম্যপথ সদরদরজার দিকে গিয়েছে। এর কাছে গাছের নীচে বেশ বড়ো বাজার বসেছে। …………একটা নজর-চৌকি দিয়ে আমরা ভিতরে গেলাম। ভেতরে বেশ বড়ো উঠোনের চারদিকে নানা ধরনের বাড়ি। কোনো বাড়ি ইট পাথরের সুদৃশ্য, কোনোটা কাঠখড়ে তৈরি মেরামতির অভাবে জরাজীর্ণ।“  

দোল উৎসবের প্রথম দিন হুকার এবং হজসন গেলেন রাজবাড়ি, সেখানে তাঁদের শামিয়ানার নীচে চেয়ারে বসানো হল। প্রথমে শুরু হোল নাচ-গান। হুকারের সাহেবি চোখে অবশ্য এই নাচ-গান একদমই ভালো লাগলো না। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা যে এই অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলো সেটা জানাতে হুকার ভোলেন নি। এরপর সাড়ম্বরে  রাজা এলেন, তারপর শুরু হোল দোলের মুল  অনুষ্ঠান। প্রথমে একটি ছোট মেয়েকে সাহেবি পোশাক পড়িয়ে ডল পুতুলের মত সাজিয়ে অতিথি সাহেবদের সামনে ঘোরানো হল – অতিথিরা মুগ্ধ হবেন এই আশায়। কিন্তু বেচারি মেয়েটি সারাক্ষণ তারস্বরে কেঁদে গেলো। যাই হোক, এরপর শুরু হল রঙ খেলা। প্রথমে গুঁড় রঙ ভর্তি বল ছোড়া আর পরে রঙের অভাবে ধুলো-বালি ছুড়ে রঙ খেলা দেখে সাহেবদের চোখ কপালে ! কেউ কেউ আবার অতি উৎসাহে অন্যের মুখে ধুল-বালি ঠুসেও দিচ্ছিল।  “এর থেকে  শিশুসুলভ, বিসদৃশ খেলার কথা কল্পনা করা যায় না“- এই হল হুকারের মত।  সবশেষে কাঠির মাথায় আতরে ভেজানো তুলো লাগিয়ে সবাইকে দেওয়া হল। বাইরে খোলা হাওয়ায় এসে হুকারের মনে হল তিনি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

দোল উৎসবের দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যে বেলায় শোভাযাত্রা বের হলো, হুকার এবং হজসন একটি হাতির পিঠে চেপে সেই শোভাযাত্রায় যোগ দিলেন। রাজা, দেওয়ান এবং সঙ্গিরাও একটি হাতির পিঠে ছিলেন। আরো কিছু হাতির খোলা পিঠেও বেশ কিছু মানুষ বসে ছিলেন। এছাড়াও বহু মানুষ পায়ে হেঁটেও শোভাযাত্রায় চলতে লাগলো, সঙ্গে রাজপরিবারের বিগ্রহ নেওয়া হল। এখানেও  এক প্রস্থ রঙ ছোঁড়াছুড়ি চললো। একসময় এই শোভাযাত্রা রাজবাড়ির বিশাল দীঘির ধারে এসে থামল। বিগ্রহ বহনকারী ঝকমকে শকট, মশালের আলো, বিরাট জনসুদ্র, বিশালাকায় কৃষ্ণবর্ণ হাতি আর দীঘির শান্ত জলে চাঁদের আলোর ঝিকিমিকি দেখে এমনকি হুকারও মুগ্ধ না হয়ে পারলেন না। এরপর  বিগ্রহগুলিকে একটি মাঠে এনে মাটিতে রাখা হল এবং সবাই হাতি থেকে নেমে পড়লেন। বিগ্রহ পুজা সাঙ্গ হলে আবারও রঙ খেলা হল। এই ভাবেই শেষ হল দোল উৎসব। পরদিন হাতি পাওয়া যাবে এই আশ্বাস পেয়ে হুকার এবং হজসন  তাদের তাঁবুতে ফিরে গেলেন।

পরদিন ১০ই মার্চ, সকাল বেলায় মেঘের হাঁকডাকে হুকারের ঘুম ভাঙল। খানিক বাদে বৃষ্টি থামল, সূর্যের দেখা মিললেও সারাদিন হালকা মেঘ আর হাওয়া থেকেই গেলো।

সবচাইতে বড় কথা আজ হাতি পাওয়া গেলো । তিস্তা নদীর পশ্চিম পাড় ধরে জলপাইগুড়ির উত্তর দিকে রংধামালির উদ্দেশ্যে হুকার, হজসন এবং তাঁদের সাঙ্গ-পাঙ্গরা যাত্রা শুরু করলেন। কিন্তু সে এক অন্য গল্প।

 

 

ঋণস্বীকার

১। Himalayan Journal or  Notes of a Naturalist in Bengal, The Sikkim And Nepal Himalayas, The Khasi Mountains- Sir Joseph Dalton Hooker

২। The Prisoner of Kathmandu – Charles Allen

৩। The Origins of Himalayan Studies- Edited By David M. Waterhouse

৪। হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে ডালটন হুকার – দ্বিজেন শর্মা

৫। হিমবাহে- স্যার যোশেফ ডালটন হুকার – অনুবাদ সমরেশ রায় (কোজাগরী - সম্পাদনা দেবেশ রায়)

( ছবি সৌজন্যঃ ইন্টারনেট )

 

 সূচিপত্রে যান

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

গানের লীলার সেই কিনারেঃ শুভময় ঘোষ

সান্ধ্য জলপাইগুড়ি। সূচিপত্র। ২৫ জুন ২০২২।

ছোটগল্পঃ শর্মিলার খোঁপা। সোমঋতা রায়।