তথাস্তু। পঞ্চম পর্ব। রঙ্গন রায়।
গোসানীমঙ্গল কাব্য অবলম্বনে
রঙ্গন রায়
পঞ্চম পর্ব
আগে যা হয়েছিল : কান্তনাথের বয়স এখন পাঁচ। গুরুগৃহে বিদ্যার্জন করছে। শিক্ষক মঙ্গল আচার্য বিস্মিত, তার প্রতিভা দেখে। অল্প বয়সেই বাংলা, সংস্কৃত ভাষা সহ ব্যাকরণ ও কাব্যশাস্ত্র শিখে ফেলেছে। এখন তিনি তন্ত্র-মন্ত্র ও রাজনীতি বিজ্ঞান শেখাবেন। তারপর...
ভক্তীশ্বরের গৃহ, জামবাড়ী গ্রাম, প্রাগজ্যোতিষপুরের পশ্চিমভাগ
কার্ত্তিকের শেষ। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানেই অগ্রহায়ণ এসে যাবে। বাতাসের পরিবর্তন স্পষ্ট রূপে প্রতীয়মান। উত্তরের বিপুল শৈলশিরা থেকে আগত শীতল বাতাসেরা রোমকূপে বিঁধছে। প্রতিদিন তার তীব্রতা বৃদ্ধি লক্ষ্যণীয়। রাত্রিবেলা শরীরে মৃদু কাঁথা দিতে হয়।
বিকালে দিবানিদ্রা ভাঙার পর, দাওয়ায় বসে হুঁকোতে তামাক টানছে ভক্তীশ্বর। আজ ঊষাকালে সে মঙ্গল আচার্যের কাছে গিয়েছিল। কান্তনাথকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সাতদিনের অবসর। কিছুদিন মাতৃস্নেহ পাক সে। অঙ্গনা ও তার হৃদয় কিছুদিন জুড়িয়ে দিয়ে যাক।
পিতা হওয়ার পর ভক্তীশ্বর অনুধাবন করেছে, একটি শিশুর হাসিই পারে পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট সুখের সন্ধান দিতে। বস্তুতঃ সুখের কোনও সংজ্ঞা হয় না। কে যে কখন কীসে নিজেকে সুখী অনুভব করবে, তা সম্ভবত ঈশ্বরেরও জানা নেই।
তামাক টানতে টানতে এসবই সাত-পাঁচ ভাবছিল সে। আকাশের প্রেক্ষাপটে পাখিদের ঘরে ফেরার দৃশ্য যেন একটি চিত্ররূপ নির্মাণ করেছে। কলকাকলি শ্রবণে বোঝা যায়, এই স্বাধীন উড্ডয়নেই ওরা সুখী।
কিন্তু সুখ কি শুধু এতেই হয়? আজ কান্তনাথকে নিয়ে আসবার সময় পণ্ডিত মহাশয় যখন বললেন, "ভক্তীশ্বর, তুমি ভীষণ ভাগ্যবান, এমন একটি সন্তানের পিতা হয়ে।" তখন নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখী মানু্ষ মনে হয়েছিল।
কিন্তু তারপরই যখন বললেন, "ওর পোশাক সংখ্যা এত সঙ্কীর্ণ কেন? কিছুদিনের মধ্যেই শীতকাল এসে যাবে। ওর তো কষ্ট হবে! এই সাতদিনের অবসরে অবশ্যই ব্যবস্থা কোরো।" তখন সুখের অন্তরালেও চোরাগোপ্তা দুঃখে, বুক ফেঁটে গিয়েছিল তার।
এসব ভাবনার মাঝে, আঙিনায় শুকোতে দেওয়া শাড়ি তুলতে বেরিয়ে আসে অঙ্গনা। স্ত্রী'কে দেখে তামাক টানা থামাল ভক্তীশ্বর। বলল, "অঙ্গনা, মা চণ্ডীর দয়ায় গরিবের ঘরে এমন পণ্ডিত পুত্র পেয়েও সুখ যে আসে না কিছুতেই।"
বস্ত্রগুলি বাম হাতে চেপে ধরে অঙ্গনার ভ্রু সামান্য কুঞ্চিত হল।
"মা চণ্ডী পুত্র দান দিল ঠিকই, কিন্তু তাকে বস্ত্র-অলংকার কিছুই যে দিতে পারি না আমরা। ন্যুনতম খাদ্য ব্যতীত আর কিছুই দিতে পারিনি কোনোদিন!"
ভক্তীশ্বর ডুকরে উঠল সামান্য। অঙ্গনা তাড়াতাড়ি তার পাশে গিয়ে বসল। স্নেহের হাত বুলিয়ে দিল মাথায়। বলল, "দুঃখ কোরো না গো। মা চণ্ডী নিশ্চয়ই এর ব্যবস্থা করবেন। তাঁর কৃপায় বিশ্বাস রাখো।"
"বিশ্বাস! বিশ্বাস কেন রাখব? কান্তনাথ বড় হয়ে রাজা হবে। মা চণ্ডীর আশির্বাদ সেটা। কিন্তু এটা মেনে নেওয়াও যন্ত্রণার, যে সেই রাজা শৈশবে পাচ্ছে না পরিধানের প্রয়োজনীয় বস্ত্র! সব দায় কি মা চণ্ডীর একার? আমি পিতা, আমার কোনো দায় নেই? আমি পারি না ওকে কিছু দিতে। আমার দারিদ্র্য এটা। আমার ব্যর্থতা!"
প্রবল আক্ষেপের সঙ্গে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে ভক্তীশ্বর। অঙ্গনা তাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে নিজেও জানে, এই অপারগতার কোনো সান্ত্বনা হয় না। তার নিজের বুকেও একই দুঃখ বহমান।
বৎসর দুই পূর্বে মোড়ল মহাশয় এবং মিত্র সোমদেব, স্নেহের কান্তনাথের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ভক্তীশ্বর সেই সহায়তা গ্রহণ করতে রাজি হয়নি। তার আত্মাভিমানে লেগেছিল। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কোন পিতাই বা চায়, তার সন্তান প্রতিবেশীদের দয়ায় বড় হয়ে উঠুক!
সন্ধ্যাতারা ফুটে উঠেছে পশ্চিম আকাশে। হিমের সামান্য পরশ নিয়ে বিষণ্ণ হেমন্তের সাঁঝবেলা নেমে আসে জামবাড়ী গাঁয়ে। অঙ্গনা উঠে গিয়ে তুলসীতলায় জ্বালিয়ে দেয় সন্ধ্যাপ্রদীপ। ভক্তীশ্বর যায় আহ্নিক সারতে। এদিকে বালক কান্তনাথ প্রাঙ্গণ থেকে ফিরে আসে খেলা সেরে। ধূলিকণা মেখে তাকে এখন শ্রাবণ মাসের মেঘের মতন দেখাচ্ছে। যেন বৃষ্টি পড়লেই ধবল আকাশ দেখা দেবে।
পরদিন প্রত্যুষে নিদ্রাভঙ্গ হলে ভক্তীশ্বর দেখে, অপূর্ব সুন্দরী কয়েকজন রমণী তার বাড়ির আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে। আলো ফুটে গেছে এখন। তাই তাদের রূপ পরিদর্শন করে বিস্মিত হয় সে। এমন দেবীর মতন রূপসী নারী সমগ্র জামবাড়ী গ্রামে নেই। তাহলে এঁরা কোত্থেকে এসেছেন? অপ্সরা নন তো?
গুরুগৃহে ব্রহ্মচর্যের শিক্ষায় দীক্ষিত কান্তনাথ উঠে গেছে বহু পূর্বেই। তার কণ্ঠে বেদস্তোত্র শোনা যাচ্ছে। এমনতর শান্তিমন্ত্র উচ্চারণ, মন ও সারা পরিবেশ পবিত্র করে দেয়। তদ্গত ভক্তীশ্বর বাইরে বেরিয়ে এসে হাতজোড় করে বলে, "আপনারা কারা মহিয়সী? মানবী, না দেবী?"
তারা হেসে ওঠে ভক্তীশ্বরের কথায়। এ-ওর গায়ে মৃদু ধাক্কা দেয়। বলে, এই, তুই বল! না না, তুই বল না! আরে বাবা, বল না! ধুর!
তারপর একজন, যার মুখশ্রী সবচেয়ে অপরূপ, পাকা গমের মতো বর্ণ, সে এগিয়ে এসে বলল, "আমরা তোমার সঙ্গে নয়, অঙ্গনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।"
কণ্ঠস্বরে যেন বিহঙ্গ ডেকে উঠল। ভক্তীশ্বরের, স্ত্রী'কে ডাকবার জন্য ভেতরে যেতে হল না। তাদের হাস্যকলরোলই, কৌতুহলী অঙ্গনাকে বাইরে নিয়ে এল।
এরপর ভক্তীশ্বর অবাক হয়ে লক্ষ করল, অঙ্গনা তাদের দেখে যেন অত্যন্ত পুলকিত। ওদের মধ্যে থেকে একজন রমণী অঙ্গনার হাত ছুঁয়ে বলল, "আমরা পাশের গাঁ থেকে এসেছি গো। শুনেছি জামবাড়ীতে আমাদের ভবিষ্যতের রাজা বেড়ে উঠছেন! তাই আমরা সমস্ত মেয়েরা ঠিক করেছি, সবাই মিলে তোমার ছেলেকে আশির্বাদ করে যাব। ও তো শুধু তোমারই নন্দন নয় গো! আমাদেরও তো নন্দন। তাই না!"
এই প্রভাতবেলা ছেলেকে আশির্বাদ করতে অন্যান্য গ্রাম থেকে নারীগণ এসেছেন শুনে, মাতৃত্বের পরিতোষে তাদের ঘরে নিয়ে গেল অঙ্গনা। কান্তনাথ তখন অধ্যয়ন করছিল একটি পুঁথি থেকে। ওরা ওকে দেখে রীতিমতো চমকিত হল, "ও মা! কী সুন্দর সুলক্ষণযুক্ত শিশু! কন্দর্পকান্তি যেন। বড় হলে কত নারীর হৃদয় যে পুড়বে ওর রূপের আগুনে, ভগবানই জানেন। নজর না লেগে যায় কারুর!"
এই বলে ওরা একে একে কান্তনাথকে নিজেদের আঁচলের গিঁট থেকে খুলে আনা অলংকার পরিয়ে দিতে শুরু করল। কান্তনাথ গম্ভীর বালক। অধ্যয়ন একাগ্রচিত্তে করবার জিনিস। সে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল এইসব কার্যে। কিন্তু মাতৃস্থানীয় রমণীদের কিছু বলতেও পারল না। অঙ্গনা, "আরে করো কী! করো কী!" বলতে বলতেই তারা কান্তনাথের হাতে পরিয়ে দিল স্বর্ণ বলয়। পদযুগলে দিল নূপুর। একজন তার কটিদেশে দিল কিঙ্কিনী পরিয়ে, অন্যজন গলায় দিল চমৎকার মতিহার। এই ভাবে সমগ্র অঙ্গ অলংকারে সজ্জিত করে তবে ক্ষান্তি দিল তারা। সবশেষে, সেই বিহঙ্গ কণ্ঠী, গমরঙা মেয়েটি দিল কান্তনাথের মাথায় অতি মূল্যবান সুদর্শন একটি টোপর পরিয়ে। তারপর বলল, "এবার তোমায় দেখাচ্ছে আমাদের প্রকৃত রাজকুমারের মতন।"
আশির্বাদ শেষ করে ওরা চলে গেলে স্তম্ভিত ভক্তীশ্বর ও অঙ্গনা কিছুক্ষণ নিষ্পলক নয়নে চেয়ে রইল ওদের চলে যাওয়ার দিকে। তারপর একসময়, ডুকরে কেঁদে উঠল। এই অলংকার লাভ যে মাতা চণ্ডীরই লীলা! মা তাঁর মানসপুত্রকে নিরালংকার ও বস্ত্রহীন দেখে নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছিলেন! তাই তো এই অপ্সরী রূপী মেয়েগুলির আগমন! আশির্বাদের ছল করেই দিয়ে গেল অপার সম্পদ।
বাইরে পাখিদের কলরব বেড়েছে। জামবাড়ী গ্রামের অন্যান্য বাড়ি গুলিও জেগে উঠেছে বোঝা যায়। সকালের নিজস্ব যে শব্দ, তা কর্ণগোচর হচ্ছে। সামনের বটবৃক্ষের ডালে, একটি শালিখ পাখি আরেকটি শালিখ পাখির পাশে গিয়ে বসল। কৈলাসেও এখন, চণ্ডীর গবাক্ষে দুটি নাম না জানা পরিযায়ী পাখি এসে বসেছে। তিনি কয়েকটি চালের দানা সম্মুখে ছড়িয়ে দিয়ে মুচকি হাসলেন। তার নির্দেশে যোগিনীগণ নিশ্চয়ই এতক্ষণে ভক্তীশ্বর ও অঙ্গনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করেছে।
(চলবে)
সান্ধ্য জলপাইগুড়ি পিডিএফ প্রকাশনা থেকে লেখকের চারটি থ্রিলার গল্পের সঙ্কলন 'থ্রিলার চার'। বইটির নমুনা বিনামূল্যে পড়ুন থ্রিলার চারঃ রঙ্গন রায়। পিডিএফ। ৩০.০০ টাকা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন